ভোলা প্রতিনিধিঃ
খেজুর রসের স্বাদ ভুলতে বসেছে ভোলার সাধারণ মানুষ। বাজারে পাওয়া যায়না খেজুর গুড়ের মনমাতানো সেই ঘ্রাণ। ভোলার গ্রাম অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ও শিশির ভেজা ভোরে শিয়ালীদের (খেজুর রস বিক্রেতা) হাক-ডাক এখন আর শোনা যায় না। ইটের ভাটায় অবাধে খেজুর গাছ পোড়ানোর ফলেই খেজু গাছ বিলুপ্ত হতে চলছে বলে সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করছে।
দ্বীপে রানি নামে খ্যাত দ্বীপ জেলা ভোলার শীতের ঐতিহ্য ছিল মিষ্টি খেজুর রস। মাত্র এক যুগের মাথায় খেজুর রসের স্বাদ ভুলতে বসেছে জেলার প্রায় ২২ লক্ষ মানুষ। রসের পায়েস এখন শুধুই স্মৃতি। ১২-১৪ বছর আগে শীতের সকালে ভোলার গ্রাম অঞ্চল গুলোতে মানুষের ঘুম ভাঙত শিয়ালীর (রস বিক্রেতা) হাক-ডাকে। এখন আর সেই ডাক শুনতে পাওয়া যায় না। শীতে গ্রাম্য হাটে খেজুরের গুড়ের সেই মনমাতানো ঘ্রাণ এখন আর নেই । এখন যশোর থেকে আসা চিনি মেশানো ভেজালে ভরা নিন্ম মানের গুড় বাজার গুলোতে বিক্রি হচ্ছে। বাজারের সেই ভেজাল মেশানো গুড়েই রসনায় তৃপ্ত হচ্ছে ভোলার মানুষ।
এক সময়ে ভোলার অধিকাংশ কৃষকই তার কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি রাস্তার পাশে অথবা বাগানে ও বিলের আতালে বেড়ে ওঠা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেতো। শিয়ালীরা বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ কাটার জন্য কার্তিক মাস থেকেই নেয়া হতো প্রস্তুতি। অগ্রহায়নের শুরু থেকে গাছে চুঙ্গিতে হাড়ি বসিয়ে নিয়মিত রস সংগ্রহ করা হতো। শীতের তীব্রতার সাথে সাথে রসের মিষ্টি স্বাদও বেড়ে যেত দ্বিগুন। এই রস চৈত্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাওয়া যেত। শীতের রাতে চুরি করে খেজুর রস খাওয়ার শৈশব স্মৃতি এখনো মনে করেন অনেকে।
একটি বেসরকারি এনজিওর হিসাব অনুযায়ী ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত জেলায় লক্ষাধিক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হতো। রস দিয়ে পিঠে, পায়েশ খাওয়ার পাশাপাশি দেড়‘শ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন করা হতো। ১৯৯৪ সালে ইট ভাটায় কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ করে খেজুর গাছ ও বাশের মোতা পোড়ানোর অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়। বাশের মোতা না থাকায় ভোলার সকল ইট ভাটায় পোড়ানোর জন্য খেজুর গাছ নিধন শুরু হয়। কম দামে অধিকাংশ খেজুর গাছ ইট ভাটার বলি হয়। গত এক যুগে ক্রমেই খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারনে খেজুর রস কমতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এখন তা বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের কালাসুরা এলাকার শিয়ালী আব্দুল লতিফ জানান, আগে তিনি শীত মৌসুমে ৬০টি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতেন। সংগ্রহীত রস দিয়ে পিঠে, পায়েশ খাওয়ার পাশাপাশি গুড় তৈরী করে বছরে ২০-৩০ হাজার টাকা আয় করতেন। কিন্তু এখন সেই খেজুর গাছ নেই। অধিকাংশ গাছ কেটে জমি অন্য কাজে ব্যবহার করেছেন। মাত্র ৬টি গাছ বেঁচে আছে তা থেকে এখন আর রস সংগ্রহ করা হয়না। মেঘনা যুব উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এর সভাপতি দাউদ ইব্রাহিম সোহেল বলেন, এক সময় ভোলার গ্রামগঞ্জে রাস্তার পাশে ও ধান ক্ষেতের আইলে প্রচুর খেজুর গাছ দেখা যেতো। আমরা রাতে গাছ থেকে রস পেরে নাস্তা খেতাম। তাওয়ায় রস জাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হতো। সেই গরম গুড় মুড়ি দিয়ে মেখে খেতে খুবই ভালো লাগতো। বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি করা হতো। এখন এগুলো শুধুই ইতিহাস। গ্রাম গঞ্জে আগের মতো আর সারিবদ্ধ খেজুর গাছ নেই। ইটভাটার কারণে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি মোবাশ্বের উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ভোলায় এখন আর আগের মতো সারিবদ্ধ খেজুর গাছ চোখে পড়ে না। আগে শীত আসলেই খেজুর রসের নাস্তা খেতাম। এখন তা শুধু স্বপ্ন। ইটভাটার কারণে খেজুর গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন যদি সবাই বেশি বেশি করে খেজুর গাছ রোপন করে তাহলে এই বিলুপ্ত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে জেলায় বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় তালগাছের চারা রোপন করা হয়েছে। এই সংগঠন গুলোর উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছও রোপন করা উচিত।
ভোলা প্রচার অভিযানের সভাপতি ও ভোলা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক এ্যাড. নজরুল হক অনু বলেন, মরহুম মোশারেফ হোসেন শাহাজাহান তৎকালিন সময়ে মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ভোলায় খেজুর গাছের বিলুপ্তির আশংকা দেখে সেদিন সবাইকে খেজুর গাছ লাগানোর জন্য আহ্বান করেছিলেন। তখন অনেকেই হেসেছেন। শাহাজাহান সাহেবকে নিয়ে বিদ্রুপ করেছিলেন। আজকে দুই যুগ পরে এসে প্রমাণিত হলো শাহাজাহান সাহেবের কথাই সঠিক ছিলো। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন খেজুর গাছ বিলুপ্ত হলে বাঙালীর দীর্ঘদিনের খেজুর গুড় আর রসের নাস্তা খাওয়ার ঐতিহ্য বিলুপ্ত হবে। তাই শাহাজাহান সাহেবের উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে আমাদের সকলের এখনও উচিত বেশি বেশি করে গাছ লাগানো। এডভোকেট অনু মনে করেন ইট ভাটা গুলো যেভাবে খেজুর গাছ ধ্বংস করছে জেলা প্রশাসন একটু নজর দিলেই ইটভাটা গুলোর হাত থেকে অনেক গাছ বাজানো সম্ভব।
ভোলা প্রেসক্লাবের যুগ্ম আহ্বায়ক ওমর ফারুক বলেন, খেজুর গাছ পরিবেশ ও ভূমি রক্ষা রোধে খুব উপকারী। আমরা আমাদের সামান্য স্বার্থে উপকারী গাছটিকে নিধন করে পক্ষান্তরে আমাদেরই ক্ষতি করছি। পরিবেশ রক্ষায় এবং রসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে রাস্তার পাশে খেজুর গাছ লাগানোর দাবী জানান তিনি।