কৃষিবিদ ড. এস.এম. রাজিউর রহমানঃ
বিশ্ব ডিম দিবস-২০২৪ উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য হলো “United by Eggs” যা সারা বিশ্বের মানুষকে ডিমের পুষ্টির মাধ্যমে একত্রিত করার আহ্বান জানায়। ডিম একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য যা শরীরের স্বাস্থ্য বিকাশ ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ ও উচ্চমানের প্রোটিন যা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অপরিহার্য। ডিমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্ত, যা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ করে।
ডিমের পুষ্টিগুণের পাশাপাশি, এটি পরিবেশবান্ধব খাদ্য হিসেবে বিবেচিত, কারণ এর উৎপাদনে তুলনামূলক কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। ডিম বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎসবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা সামাজিক সংহতি বৃদ্ধিতে সহায়ক। ডিম উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে সহজলভ্যতা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় চাষীদের সহায়তা প্রদান করে, যা স্থানীয় অর্থনীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পিএইচডি গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ডিম খাওয়া সত্ত্বেও কোলেস্টেরল বাড়ে না, বরং এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল প্রায় ২০ শতাংশ কমে যায়। গবেষকরা ব্যাখ্যা করেছেন, ডায়েটরি কোলেস্টেরল শরীরে চোলেজন হরমোনের মাত্রা বাড়ায়, যা লিভারের একটি রিসেপ্টরের সঙ্গে মিশে ভালো ও খারাপ কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়া, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা সপ্তাহে ১২টি ডিম খেলেও খারাপ কোলেস্টেরল বা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে না, বরং ভালো কোলেস্টেরলের (এইচএলডি) মাত্রায় উন্নতি ঘটে (যুগান্তর ০৮ অক্টোবর ২০২৪)।
বাংলাদেশেও ডিম পুষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ বছর বাংলাদেশে “বিশ্ব ডিম দিবস-২০২৪” উদযাপিত হচ্ছে, যার প্রতিপাদ্য “ডিমে পুষ্টি, ডিমে শক্তি, ডিমে আছে রোগ মুক্তি।” পূর্বে ডিম দিবসের উদ্দেশ্য ছিল ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং কুসংস্কার দূর করা, । তবে বাংলাদেশে ডিমের পর্যাপ্ততা ও মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক জনগণের জন্য ডিম ক্রয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক ডাটাবেজ তৈরি করা, যেখানে ডিমের উৎপাদন, প্রাপ্যতা ও প্রয়োজনীয়তার নির্ভুল তথ্য থাকবে। সরকারের উচিত ডিম উৎপাদন, কারিগরি সহায়তা ও উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা। ডিমের সাপ্লাই চেইনে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার পোল্ট্রি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে প্রান্তিক খামারিদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, টিকা, ঔষধ ও জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। সরকারি খামারগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে সোনালি মুরগির বাচ্চা বিতরণ করা যেতে পারে, যা ডিমের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আমাদের দেশে প্রতিদিন ৫ কোটি ডিমের চাহিদা থাকে, তবে ৫০,০০০ খামার স্থাপন করা প্রয়োজন, যেখানে প্রতিটি খামারে ১১০০টি ডিম পাড়া লেয়ার মুরগি পালন করা যেতে পারে। প্রতি মাসে ৫০,০০০ খামার স্থাপন করে ছয়-সাত মাসের মধ্যে দেশব্যাপী ডিমের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব । এই খামারগুলোকে উপজেলা ও জেলাভিত্তিক ভাগ করে স্থাপন করা যেতে পারে। সরকারকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একদিনের মুরগির বাচ্চা ও খাদ্য সরবরাহের বিষয়ে প্রান্তিক খামারিদের জন্য দায়িত্বশীল করতে হবে। এজন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে একটি রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে আনতে হবে, যাতে তারা সঠিকভাবে এই উপকরণগুলো সরবরাহ করতে পারে।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলির মাধ্যমে এই খামারগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এছাড়া, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থাগুলিও এতে জড়িত হতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ খামার স্থাপনের প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ডিমের চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।
খামার সমূহকে অবশ্যই ক্লাইমেট স্মার্ট প্রাক্টিস সমূহ বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠিত করলে হঠাৎ দুর্যোগের মাধ্যমে খামারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে সরকারকে অবশ্যই প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। এরূপ উদ্যোগের মাধ্যমে মুরগির ডিম ও মাংসের টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থাপনা চালু রাখা সম্ভব। এই উদ্যোগগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে, বাজার তদারকি সঠিকভাবে পরিচালিত করলে, ডিমের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত হবে। ফলশ্রুতি ডিমের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে, যা জাতীয় পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।