বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ের বিভিন্ন ধারণা বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র
ব্যবসায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
কেননা বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষুদ্র
ব্যবসায় একটি জনপ্রিয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড।
ক্ষুদ্র ব্যবসায় হচ্ছে এমন এক ধরণের ব্যবসা , যেখানে স্বল্প পুঁজি ও শ্রমিক নিয়ে
ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করা হয়। যদিও কোনো একটি দেশের অর্থনৈতিক
উন্নয়নের গতিধারা পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন করে ক্ষুদ্র ব্যবসার আয়তন ও
পরিধি বদলায়। আধুনিক ব্যবসা জগতের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, বৃহৎ পুঁজির
ব্যবসা থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসাতেই অনেক লাভ ও সুবিধা পাওয়া যায়। এছাড়া ক্ষুদ্র
ব্যবসাতে লাভের পাশাপাশি সাফল্যেরও অনেক কারণ রয়েছে।
ক্ষুদ্র ব্যবসা গঠন করা সহজ। যে কোনো ব্যক্তিই মাত্র কয়েক হাজার টাকা পুঁজি
নিয়েই নিজের ক্ষুদ্র ব্যবসা গঠন ও পরিচালনা করতে পারেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায় যদিও
একমালিকানা ভিত্তিক হয়ে থাকে , তবে বেশ কয়েকজন মিলেও পুঁজির পরিমাণ
কিছুটা বাড়িয়ে বেশ ভালোভাবে ক্ষুদদ্র ব্যবসা পরিচালনা করা যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়
সাধারণত পাঁচজনের বেশি শালিক থাকে না। ফলে যে কোনো সময় যে কোনো
ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। তাছাড়া ক্ষুদ্র
ব্যবসায় তেমন কোনো আইনগত জটিলতা দেখা যায় না।
ব্যবসাক্ষেত্রে ক্রেতাই হচ্ছে ব্যবসার প্রাণ। ক্রেতা শূন্য ব্যবসা একসময় অস্তিত্ব
হারায়। বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্রেতার চিন্তা-চেতনা বা স্বাধীনতা কিংবা ক্রেতার
সিদ্ধান্ত বা পছন্দের দাম নেই বললেই চলে। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায় ক্রেতাকে খুব
ভালোভাবেই সন্তুষ্ট করা যায়। ক্রেতার রুচির সাথে মিলিয়ে পণ্যের পরিবর্তণ আনাসম্ভব হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসার আরেকটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায় ক্রেতার
সাথে বিক্রেতার সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। যার ফলে ক্রেতা সাধরণের
সাথে সুসম্পর্ক রাখাও সম্ভব হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত মালিকানা
পক্ষের যে কোনো সমস্যা মাত্র কয়েকজন মিলে সহজে ও দ্রæততম সময়ে সমাধান
করাও সম্ভব হয়। ফলে জটিলতা এড়িয়ে সহজে সমস্যাসমূহ সমাধান করা যায়।
ক্ষুদ্র ব্যবসায় শ্রমিক ও মালিকদের মাঝে তেমন দুরত্ব থাকে না বা দুরত্ব সৃষ্টি
হওয়ার সুযোগ থাকে না। যার ফলে মালিক পক্ষের সাথে শ্রমিক পক্ষের সম্পর্ক ভালো
হয়ে থাকে। ক্ষুদ্র ব্যবসায় মার্কেটিং থেকে শুরু করে অনেক কাজেই মালিক
পক্ষকেই নাক গলাতে হয় , যার ফলে কাজ করার পাশাপাশি মালিকের নিজেরও জ্ঞানের
পরিধি বৃদ্ধি পায়। ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষেত্রে স্থানজনিত কোনো সমস্যা থাকে না। কারণ
যে কোনো জায়গাতেই ক্ষুদ্র ব্যবসায় শুরু করা যায়। একই সাথে এ জাতীয়
স্থানান্তরের বেলায়ও তেমন জটিলতা থাকে না। ফলে এ ধরণের ব্যবসায় দ্রæত
অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি ব্যক্তি উন্নয়ন ও সামগ্রিক উন্নয়ন
সহজতর হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে রিচার্ড ক্যান্টিওন সর্বপ্রথম ঊহঃৎবঢ়ৎবহবঁৎ শব্দটির সাথে
আমাদের পরিচয় করান। পরবর্তীতে ফরাসী অর্থনীতিবিদ ব্যাপটিস্ট শব্দটিকে
বিশ্বব্যাপী প্রসার ঘটান। সাধারণ অর্থে একটি সংগঠন স্থাপনের প্রাথমিক
উদ্যোগ যে গ্রহণ করে তাকে উদ্যোক্তা বলে।
একজন ব্যক্তি যখন নিজের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে কোনো চাকুরি বা
কারো অধিনস্ত না থেকে নিজে থেকেই কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার
চেণ্টা করেন বা পরিকল্পনা শুরু করেন তখন তাকে উদ্যোক্তা বলা হয়।
একজন উদ্যোক্তা হতে পারেন নারী কিংবা পুরুষ। একজন নারী যখন নিজের
কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে কোনো চাকুরি বা কারো অধিনস্ত না থেকে
নিজে থেকেই কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার চেণ্টা করেন বা পরিকল্পনা শুরু
করেন তখন তাকে আমরা নারী উদ্যোক্তা বলতে পারি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক
অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন নারী শুধু চাকরির বাজারে নয়, বরং নিজে
উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারেন।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান বাণিজ্যিক শক্তি। সময়ের পথচলায় আমাদের দেশে
নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও এ পথে নারীদের অনেক বাধা-
বিপত্তি মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যমান এই বাধাকে কাটিয়ে
অনেক নারী উদ্যোক্তা আজকাল তাদের কর্মের মাধ্যমে সফলতার অনেক উচ্চ শিখরে
পৌঁছে গেছেন। এখন মানুষের মন থেকে নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে অবজ্ঞার যে ভাব
ছিলো তা অনেকাংশে কেটে গেছে। নারী তার কাজ, নিষ্ঠা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে
পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ২ লাখ ৩৩ হাজার
১৮৯ জন। তবে পুরুষের তুলনায় এ সংখ্যা নিতান্তই কম হলেও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা
গত এক দশকে ১২৬ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে ২০০২-০৩ অর্থ বছরে এ সংখ্যা ছিল
মাত্র ২১ হাজার ৮৬৭ জন এবং ২০০৯-১০ অর্থ বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৮৯
হাজার ৮৪৮ জন। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় বিগত দশকে তা বৃদ্ধি পেয়েছে
কয়েক গুণ। উল্লেখ করার মত বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের মোট উদ্যোক্তার মধ্যে ৬০
শতাংশই নারী।
বর্তমান বিশ্ববাজার এখন সামগ্রিকভাবে অনলাইন নির্ভর হয়ে গড়ে উঠেছে।
বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনেক নারী উদ্যোক্তাই নিজস্ব ব্যবসা শুরু
করেছেন। এছাড়াও অনলাইন পোর্টালগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখলে দেখা যায় সফল নারী
উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যম ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। গত বছর মেটা তাদের
‘শিমিনসবিজনেস’ কর্মসূচি বাংলাদেশেও চালু করেছে। বাংলাদেশ উইমেন
চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও লাইটক্যাসল পার্টনার্সদের সঙ্গে মেটা
বাংলাদেশে এই কর্মসূচি শুরু করে নতুন অনলাইন নারী উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিব্যবহার ও সম্পর্ক তৈরিতে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে
ডিজিটাল টুলস ও প্লাটফর্ম ব্যবহার করে দেশজুড়ে ‘শিমিনসবিজনেস’ ১০
হাজারের বেশি ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন নারী শুধু
চাকরির বাজারে নয় বরং নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও
গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারেন।
অনলাইন ভিত্তিক উদ্যেগে বস্ত্র, গয়না, সাংসারিক পণ্য, শিশুখাদ্য, প্রসাধনীর
আধিক্য দেখা গেলেও সীমিতসংখ্যক সেবা ও প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগ চোখে
পড়ার মতো। এই মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের তুলনামূলক বেশি উপস্থিতি লক্ষণীয়।
একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায় যে সামাজিক, পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও
প্রতিবন্ধকতা বিশেষ বাাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না বলে অনলাইন উদ্যোগে নারীদের এই
স্বচ্ছন্দ পদচারণা।
সময় পাল্টেছে, বাস্তবতা এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিন্নমুখী। এখন থেকে ৩০ বছর
আগের বাংলাদেশের অর্থনীতি আর ২০২৩ সালের অর্থনীতির হিসেব বহুমাত্রায়
ভিন্ন প্রকৃতির। এখন পারিবারিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী তাঁর
সত্তাকে এই সমাজে সফলভাবে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম।
জীবনের রঙগুলো বড় বেমানান লাগে যখন মনের চাহিদা মেটে না। একজন উদ্যোক্তা
(নারী) সে বেমানান ছবির শিল্পী, যিনি মনের রঙকে চাহিদার তুলি দিয়ে আঁকেন।
যখন তার একটি বড় স্বপ্ন থাকে, তিনি সফল উদ্যোক্তা হওয়ার সমান সম্ভাবনা
রাখেন। তিনি সফল হন , স্ববলম্বী হন প্রথমত অর্থনৈতিকভাবে এবং পরবর্তীতে
সৃষ্টিশীল কর্মে নব উদ্যোম ও মহিমায়। অবারিত হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের নব
দিগন্ত। এভাবেই একজন সফল নারী উদ্যোক্তার মাধ্যমে সামগ্রিক উন্নয়নের স্বপ্নউন্মোচিত হয় অসংখ্য উদ্যোক্তার মননে ও মেধায়।
লেখক: মো. আতিকুর রহমান
প্রভাষক অর্থনীতি বিভাগ
ভান্ডারিয়া মজিদা বেগম মহিলা কলেজ।